আরজিনা খাতুন, লিপি বেগম, সুলতানা আক্তার, আয়েশা বেগমকে এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না। শুনতে হয় না স্বামীর গালমন্দও। কারণ, এখন সংসারে অর্থ জোগান দিচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের মতো রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের হাজারো নারী ব্লিং লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেডে জুতা তৈরি করে দারিদ্র্যকে জয় করেছে। সংসারে এসেছে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। তাঁদের হাতে তৈরি জুতা ইউরোপুআমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ইতিবাচক কোনো পরিবর্তনের শুরুটা হয় কারও হাত ধরেই। তারাগঞ্জের সেই শুরুটা করেছিলেন দুই সহোদর মো. হাসানুজ্জামান ও মো. সেলিম।
নীলফামারী সদরের বাবুপাড়া গ্রামে তাঁদের বাড়ি। তারাগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মহাসড়কের পাশে ঘনিরামপুর গ্রামে সাড়ে ৯ একর জমির ওপর ওই জুতা কারখানা গড়ে তোলেন তাঁরা। হাসানুজ্জামান বলেন, আশির দশকে তাঁরা দুই ভাই বিদেশে পাড়ি জমান। আমেরিকায় শুরু করেন আবাসন ব্যবসা। সেখানে ব্যবসায় সফলতা আসে। এরপর দেশরে মাটিতে বিনিয়োগের চিন্তা করেন। সেই চিন্তা থেকেই ২০০৯ সালে নীলফামারীতে ও ২০১২ সালে মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষকদের জন্য বীজ ও আলু সংরক্ষণরে জন্য হিমাগার স্থাপন করেন। ব্লিং লেদার নামের জুতা কারখানা তারাগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালে। এখানকার জুতা এখন ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৮০০ মানুষের। ২০২৩ সালে বড় ভাই মো. সেলিম মারা যান। হাসানুজ্জামান বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির চেয়্যারম্যান।
আজ শুক্রবার ওই প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় ইউনিটের উদ্বোধন করা হয়েছে। রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম ফিতা কেটে এই ইউনিটের উদ্বোধন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হাসানুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক খাজা রেহান বখ্ত। সরেজমিনে দেখা গেছে, ৩০০ শ্রমিকের থাকার জন্য আবাসিক ভবন রয়েছে এ কারখানায়। তাইওয়ান থেকে আনা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে কারখানার ভেতরে জুতা তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকেরা। শ্রমিকদের ১০ ভাগ পুরুষ ও ৯০ ভাগ নারী। ভবনটির চারদিকে শোভাবর্ধনের জন্য লাগানো হয়েছে ফুলের গাছ। কারখানার অন্তত ৫০ জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঁচ থেকে ছয় বছর আগেও তাঁদের নির্দিষ্ট কোনো আয়ের পথ ছিল না। বছরের অর্ধেক সময় কাজের খোঁজে গ্রামের বাইরে থাকতে হতো পুরুষদের। কাজের অভাবে উঠতি বয়সের তরুণ ও নারীরা অলস সময় কাটাত। কারখানা গড়ে ওঠায় গ্রামবাসীর কর্মহীনতা ঘুচেছে। উপার্জন বেড়েছে, বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের মার্জিনা খাতুন (৩১) জানান, ভিটামাটি ছাড়া কিছু ছিল না। এখন টিনের ঘর ও নিজের ৪ শতাংশ জমি আছে।
গাছগাছালি ঘেরা বাড়িতে হাসমুরগি, ছাগল ও গাভি পালন করছেন। জুতা তৈরির কাজ করে মাসে ১০ হাজার টাকা আয় করছেন। সন্তানেরা স্কুলে যাচ্ছে সংসারে তাঁর (মর্জিনা) মতামতও এখন গুরুত্ব পায়। কথা হয়, কারখানায় কর্মরত হাজীরহাট গ্রামের নারী শ্রমিক সীতা রানীর সঙ্গে (২৫)। তিনি বলেন, ‘স্বামী ছেড়ে গেছে তিন বছর আগে। খুব সমস্যায় ছিলাম। পরে ব্লিং লেদারে এসে প্রশিক্ষণ নেই। তারপর এখানে চাকরিও করছি। এখন আর কোনো চিন্তা নেই। মাস গেলেই টাকা পাচ্ছি ভালো আছি।’ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘দেশে নারীদের র্কমসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বড় ভাই সেলিমের উদ্যোগে নিভৃতপল্লীতে কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। কারখানাটি পরিচালনা করার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতা পাচ্ছি। গ্রামীণ নারীদের ছোঁয়ায় ৩০০ জোড়া থেকে এখন ১০ হাজার জোড়া জুতা উৎপাদন হচ্ছে। ২০২৬ সালের শেষে দৈনিক ৫০ হাজার জোড়া জুতা উৎপাদনের ইচ্ছে আছে। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।’– সংবাদসুত্র ঢাকার দৈনিক প্রথম আলো