শাহ জে. চৌধুরী
ভারতের জনগণের ঘাম ও শ্রমে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন (খওঈ) — এক সময় যা ছিল সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও আস্থার প্রতীক, আজ সেটিই পরিণত হচ্ছে কর্পোরেট সুবিধাবাদ ও রাজনৈতিক পক্ষপাতের হাতিয়ারে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্দেশে প্রায় ৩.৯ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৩২,০০০ কোটি) এলআইসি-র তহবিল থেকে গৌতম আদানির বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে — এমন এক সময়, যখন আদানির সাম্রাজ্য আইনি ও আর্থিক সংকটে দোদুল্যমান।
এই খবরটি শুধু অর্থনৈতিক অনিয়মের ইঙ্গিত নয়, এটি রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার এক গভীর সংকেত।
রাষ্ট্রের মালিক কে — জনগণ না পুঁজিপতি?
গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের সম্পদ জনগণের; সরকার কেবল তার তত্ত্বাবধায়ক। কিন্তু যখন জনগণের সঞ্চয়, তাদের বীমার টাকাই কোনো নির্দিষ্ট শিল্পপতির ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহৃত হয়, তখন সেটি এক ভয়াবহ “নৈতিক প্রতারণা” ছাড়া আর কিছুই নয়।
এলআইসি কোটি কোটি সাধারণ ভারতীয়ের ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি — যাঁরা তাদের সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসা, অবসরের নিরাপত্তার আশায় এই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেন। আর সেই আশার টাকা যদি গোপনে, রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার কারণে, এক ব্যক্তির ব্যবসায় ঢেলে দেওয়া হয় — তবে সেটি কেবল অর্থনৈতিক অপরাধ নয়, এটি ন্যায়ের প্রতি বিশ্বাসহানিও।
আদানি: রাষ্ট্রীয় ছায়াতলে গড়া এক সাম্রাজ্যের গল্প
গৌতম আদানি ভারতের অন্যতম ধনী ব্যক্তি, কিন্তু তাঁর উত্থানের কাহিনি রাষ্ট্রীয় নীতির প্রভাবে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
বহু আন্তর্জাতিক রিপোর্টে দেখা গেছে, সরকার-সমর্থিত নীতি, অবকাঠামো চুক্তি ও বিনিয়োগের সুযোগ—সবকিছুতেই আদানির ব্যবসায়িক গ্রুপ অগ্রাধিকার পেয়েছে।
যখন বাজারে তাঁর সাম্রাজ্য নিয়ে সন্দেহ, তদন্ত ও আর্থিক পতনের আশঙ্কা দেখা দিল, তখন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন “আর্থিক সহায়তা” কেবল এক ব্যক্তিকে রক্ষা করা নয়—এটি একটি পুরো সিস্টেমকে বিপন্ন করে তোলে।
গণবিশ্বাসের সংকট: খওঈ, ঝইও, ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সংস্থা জনগণের আস্থার প্রতীক। কিন্তু যখন জনগণের এই আস্থা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়, তখন তা রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি আর জনগণের হয় না, বরং কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা ক্ষমতার হাতের খেলনা হয়ে যায় — তখন সেটিই হয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বিপজ্জনক রূপান্তর।
এটি কেবল ভারতের নয়, বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য একটি সতর্কবার্তা:
“যে মুহূর্তে রাষ্ট্র জনতার স্বার্থের বদলে গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করতে শুরু করে, সে মুহূর্তেই জনগণের উপর থেকে রাষ্ট্রের নৈতিক অধিকার হারিয়ে যায়।”
নৈতিকতার আহ্বান: এই ঘটনাকে আমি কেবল অর্থনৈতিক নয়, নৈতিক ও মানবিক প্রশ্ন হিসেবে দেখি।
জনগণের অর্থ, জনগণের স্বপ্ন, জনগণের ভবিষ্যৎ — সবই যদি এক ব্যক্তির কর্পোরেট স্বার্থের কাছে উৎসর্গিত হয়, তবে সেটি কেবল অর্থনীতির নয়, মানবতারও পরাজয়।
রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি বিশ্বাস; আর সেই বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে, তা আর কোনো মুদ্রানীতি বা বাজেট দিয়ে পুনর্গঠন করা যায় না।
আমি এই ঘটনার তীব্র সমালোচনা জানাই—
কারণ এটি আমাদের শেখায়,
গণতন্ত্র টিকে থাকে শুধু ভোটে নয়, ন্যায়ের প্রতি বিশ্বাসে।
শেষ কথা: আজকের এই ঘটনা আমাদের সামনে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় —
রাষ্ট্র কি জনগণের অভিভাবক, না ক্ষমতার দালাল?
খওঈ-এর এই লেনদেন সেই প্রশ্নের উত্তর দেয় — এক গোপন লজ্জার স্বরে।
আমরা যদি নীরব থাকি, আগামী প্রজন্ম আর কখনোই তাদের রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করতে পারবে না।




